অর্থনৈতিক দুঃসংবাদ যেন কাটছেই না বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের ডলার আয়ের প্রধান দুই খাত রেমিটেন্স এবং পোশাক রপ্তানি ইতিমধ্যে অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। ডলার-সংকটে এখন আমদানির ঋণপত্র খোলা কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। আবার আমদানি দায় পরিশোধও পিছিয়ে দিচ্ছে। গত অক্টোবর মাস থেকে শুরু হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। আগে সংকট মেটাতে ব্যাংকগুলো বেশি দামে প্রবাসী আয় এনে আমদানি দায় শোধ করছিল। এখন সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। প্রবাসী আয়ে ডলারের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের করার নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রবাসীদের পাঠানো ডলারের দাম সর্বোচ্চ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রবাসীদের পাঠানো ডলার এর পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আয়ের অনেকটা কমে গিয়েছে। বাংলাদেশের ডলার আয়ের প্রধান উৎস অনেকটাই মুখ থুবরে পড়েছে। বিদেশি ঋণ ছাড়ও কমে গেছে। পাশাপাশি বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে এনেছে। ফলে ডলার সংগ্রহের উৎসগুলো একে একে সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরার নতুন নিয়ম অনুযায়ী আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। আগে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছিল। এখন বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও খাদ্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। যেসব ব্যাংকের রপ্তানি আয় নেই, তারা ঋণপত্র খুলছে না। এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ডলারের দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ১০৭ টাকায় উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার-সংকট কাটাতে নানাভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশাপাশি সরকারি আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে ডলার বিক্রি করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৩৪ বিলিয়নের (এক বিলিয়নে ১০০ কোটি) ঘরে নেমে এসেছে।
মূলত করণা মহামারীর চলাকালীন দেশের অর্থনৈতিক সকল ব্যবস্থা থমকে যায় এ সময় অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে নানা ধরনের ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানি দায় পরিশোধের সময় ১৮০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩৬০ দিন করা হয়। পাশাপাশি দেশের সকল পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাড়তি সময় বেঁধে দেওয়া হয় সে ক্ষেত্রে রপ্তানির ব্যবস্থা অনেকটা হুমকির মুখে পড়ে।
এছাড়াও করোনা মহামারী চলাকালীন যেসব প্রবাসীরা দেশে এসেছিলেন করোনা মহামারী বন্ধ হওয়ার পর তারা যখন পুনরায় বিদেশের ফিরে যান তখন তারা তাদের চাকরি নিয়ে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়। এছাড়া অনেক প্রবাসী ব্যবসায়ীরা ব্যাপকহারে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ পূর্বের তুলনায় অনেকটাই কমে যায় যা বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঙ্কটের একটি কারণ।
এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো দেশীয় পোশাক রপ্তানি। মূলত করণা মহামারীর চলাকালীন দেশের পোশাক কারখানাগুলো পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। এ সময়ে অনেক ব্যবসায়ীরাই ব্যাপক লস এর সম্মুখীন হয়। পরবর্তীতে দেশের জ্বালানি সংকট দেখা দিলে লোডশেডিং অন্যান্য কারণে পোশাক রপ্তানি অনেকটাই কমে যায়। যার ফলে দেশের পোশাক রপ্তানির হার বর্তমানে অনেকটাই কমে গেছে। প্রতি মাসে যে পরিমাণ রপ্তানি হয়, তার পুরোটা প্রত্যাবাসন হয় না। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চে ১ হাজার ৩৯০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হলেও এ সময় দেশে এসেছে ১ হাজার ১৩৪ কোটি ডলার। আর মার্চ থেকে জুন প্রান্তিকে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হলেও দেশে এসেছে ১ হাজার ১৯৮ কোটি ডলার। সেই হিসাবে ছয় মাসে প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় আটকে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী, পণ্য জাহাজিকরণের ১২০ দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে আনতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আমদানি খরচ (জাহাজভাড়াসহ) ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সেই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩২ কোটি ডলারে।