বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষা এবং ক্রমবর্ধমান প্রবাসী-আয় সহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস কমে আসায় বর্তমান সরকার চাপের মুখে রয়েছে। এ রিজার্ভকে একটি নিরাপদ অবস্থানে রাখার জন্য সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে নানামুখী। এর মধ্যে অন্যতম একটি উপায় হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ এর কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ধার। এটি একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ব্যবস্থাপনা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আই এম এফ এর কাছ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও অনেক অর্থনীতির দিক দিয়ে সাবলীল দেশগুলো অর্থ ঋণ নিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের শুধু প্রথমবার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে তা নয় অতীতেও বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার চাপের মুখে পড়ে আইএমএফের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে ছিল।
আর সংস্থাটি সদস্যরাষ্ট্রগুলোর আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে থাকে। সুতরাং তাদের থেকে ঋণ পেলে অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ঋণের উৎসগুলো প্রসারিত হয়।
বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ঋণ সংক্রান্ত বিষয় দফায় দফায় বৈঠক করেছে। এসময় কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে তা দ্রুত সংস্কারের পরামর্শ দেয়। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছে। এবারও দিয়েছে একগুচ্ছ। সেভাবে বলা না হলেও এসব পরামর্শ শর্তের নামান্তর। এসব শর্ত সর্বাংশে প্রতিপালন আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে জুতসই না হলে সরকারের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। আবার তাদের থেকে ধার পাওয়ার গরজে ক্ষেত্রবিশেষে জনগণের জন্য কষ্টকর শর্তও মেনে নিতে হয়েছে।
অতীতে তাদের দেওয়া পরামর্শে বাংলাদেশ সরকার কৃষি খাতে ঢালাওভাবে দেওয়া ভর্তুকি কমিয়ে দেয়। এতে অর্থনৈতিক বাজেট কিছুটা উন্নতি হলেও বিপাকে পড়ে বাংলাদেশের সাধারণ কৃষকরা। ১৯৯৬ সালে পরিবর্তনের পর তখনকার সরকার কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের বিপরীতে জোরালো অবস্থান নেয়। জনসমর্থিত সে সরকারের অবস্থানকে মেনেও নেয় আইএমএফ। আর সে ভর্তুকির সুফল হিসেবে আমরা অতি দ্রুত চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করি। সাফল্য আসতে থাকে কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
এবারও এমন কিছু স্বার্থের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অর্থ সহায়তা দেবে। সংস্থাটি মূলত তাদের অর্থের মাধ্যমে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে চায় তা বলতে কোন অবকাশ রাখে না। যেমন এবারের ঋণ দেওয়ার শর্ত গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংকগুলোর নতুন করে সংস্কার করা, ঋণখেলাপি গুলো আদায় করা ইত্যাদি যা দেশের অর্থনৈতিক হাতকে আরও ত্বরান্বিত করবে বলে আমি মনে করি।
তবে দুঃখজনক বিষয় হলো কিছু শর্তের সঙ্গে তাঁরা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও ব্যাংক সুদের কাছাকাছি নামিয়ে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টি হাজার হাজার আমানতকারীর কাছে শঙ্কার কারণ হিসেবে সামনে এসেছে। সঞ্চয়পত্রনির্ভর জনগোষ্ঠী বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তাঁরা মূলত অবসরজীবী কিংবা কোনো না কোনোভাবে সঞ্চয়পত্রনির্ভর। এমনিতেই গত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুনাফার ওপর আরোপ করা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে আয়কর। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের সীমা। এ কারণে কমে গেছে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ। আর তা বিস্ময়করভাবে কম।
এক প্রতিবেদনে দেখা যায় গত অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ধার নিতে চেয়েছিলো সঞ্চয় পত্রের মাধ্যমে। প্রথম ৩ মাসে নিয়েছিল ৮ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। আর বর্তমান অর্থবছরে প্রস্তাবিত ধার ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম ৩ মাসে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ফলে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ কমে যাওয়ায় সরকারের সুদ ব্যয় কমবে।
সে ক্ষেত্রে মুনাফার হার মূল্যস্ফীতির প্রায় অর্ধেক। শেয়ারবাজারে গিয়ে আবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়তে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু যাঁরা সঞ্চয়পত্র আঁকড়ে ধরে থাকতে বাধ্য, তাঁদের আয় কমার ধকল কীভাবে পোষাবে, সেটা দুর্বোধ্য। কেউ মূলধন ভাঙাবেন। কেউবা করতে থাকবেন ধারদেনা। আর তাঁদের জীবনযাত্রার মান কমবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির সঞ্চয়পত্রনির্ভর হাজার হাজার পরিবার আজ সরকারের করুণার অপেক্ষায়।
সঞ্চয়পত্রনির্ভর লোকজনের বিষয়ে যতটুকু সংবেদনশীল হওয়া প্রত্যাশিত, তেমনটা আমরা দেখছি না তাদের কার্যক্রমে। মূলত সঞ্চয়পত্রনির্ভর লোকজন কোনো সংগঠিত জনসমষ্টি নয়। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের কোনো ক্ষমতাই তঁাদের নেই। নির্বাচনের সময়ে ব্যালটের ব্যবহারে সুযোগও সংকুচিত হয়েছে। সুতরাং আশঙ্কা থাকছে উপেক্ষিত হবে তাঁদের স্বার্থ। কেননা এসব কিছুর মধ্যেও সরকারকে আইএমএফের শর্ত কিছু কিছু পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে দিলে দৃশ্যমান প্রতিবাদ প্রতিরোধ কিছুই হবে না। এক্ষেত্রে দেশের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে চাপ ও আসার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা চাই আমাদের এই আশংকাটি ভুল প্রমাণিত হোক। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে হাজার হাজার পরিবারের জীবনযাপন সঠিকভাবে চলুক।